চিকিৎসা ব্যবস্থায় সার্বিকভাবে বাংলাদেশের নাজুক অবস্থা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। চিকিৎসক স্বল্পতা থেকে শুরু করে ডায়াগনোসিস ব্যবস্থা, যন্ত্রপাতির অপ্রুলতা ও অব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ নতুন কিছু নয়। জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপে দিন দিন আরো নাজুক হচ্ছে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ।
সেই সঙ্গে রয়েছে প্রাইভেট স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বেচ্ছাচারিতা ও তাদের ব্যবসায়িক মনোভাব। চিকিৎসা সেবা অসহায় মানুষের জন্য অধিকার থেকে এখন করুনার বস্তু হয়ে দাড়িয়েছে। চিকিৎসকরা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরন ও সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সচল রেখে চলেছেন সারা দেশব্যাপী। এর মধ্যেই সবচেয়ে অবহেলিত হচ্ছে ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা। ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা ব্যবস্থায় কারোরই যেন অবহেলার অন্ত নেই।
দেশে সার্বিক ভাবে ক্যান্সার চিকিৎসায় যথোপযুক্ত সুযোগ সুবিধা ও চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ অপ্রতুল। রোগীর ভারে আজ সরকারের নেয়া নানা পদক্ষেপেও সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হচ্ছে না। যেহেতু ক্যান্সার চিকিৎসা একটি জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি তার থেকেও জটিল ক্ষেত্র বিশেষে ক্যান্সারের ডায়াগনোসিস।
রোগীদের একের পর এক টেস্ট দেয়া হচ্ছে কিন্তু চিকিৎসা শুরু করা যাচ্ছে না, টেস্ট গুলো আবার অনেক ব্যয়বহুল এবং সময় সাপেক্ষ। এসবের পূর্নাঙ্গ ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ও রোগীদের পর্যাপ্ত কাউন্সেলিংয়ের অভাবে তাদের মধ্যে ভুলবুঝাবুঝি এসব যেন নিত্য দিনের অবস্থা।
আমাদের আগে জানতে হবে ক্যান্সার রোগটি অন্যান্য সকল রোগ থেকে অনেকটাই আলাদা। এখানে সিস্টেম অনুযায়ী বিভিন্ন স্টেইজ নির্ধারিত হয় এবং একেক স্টেজে চিকিকৎসা পদ্ধতিও ভিন্ন হয়। সকল ক্যান্সার এক রকম নয়, এই ধারণা টা সবার আগে বুঝতে হবে। আবার একই জাতের ক্যান্সারের মাঝেও অনেক রকমভেদ রয়েছে। সেগুলোর উপরেও চিকিৎসা ভিন্ন ধরনের।
সার্জারি, কেমোথেরাপি কিংবা রেডিওথেরাপি কোন অবস্থায় কখন কিভাবে দিতে হবে সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াও চিকিৎসকদের জন্য ক্ষেত্র বিশেষে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। উন্নতদেশের মত আমাদের দেশে একজন রোগীর জন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি মেডিকেল বোর্ড যেন আকাশকুসুম কল্পনা। যার কারনে এখানে থেকে সেখানে ছুটোছুটি করতে করতেই দীর্ঘায়িত হয় সঠিক চিকিৎসা।
ক্যান্সার শনাক্তকরনের জন্য শুরুতে প্রয়োজন হয় বায়োপ্সি পরীক্ষা। আক্রান্ত স্থান থেকে মাংস কেটে এনে বিশেষজ্ঞ প্যাথলজিস্ট চিকিৎসক সেটি পরীক্ষা করেন। আরো আছে এফএনসি পরীক্ষা যেটি সুই দিয়ে করা হয়। এসব ক্ষেত্রে সবসময় সঠিক ডায়াগনোসিস করা যায় না। তবে একটা ধারণ পাওয়া যায় এবং অনেকক্ষেত্রে এর মাধ্যমেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
আবার কিছু ক্ষেত্রে এই পরীক্ষাটির সাইড ইফেক্টও হতে পারে। ঝুঁকি বিবেচনায় চিকিৎসকরা এটা করে থাকেন। কিন্তু রোগী ও তার সজনরা সঠিক কাউন্সেলিং ও জ্ঞানের অভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বা অন্যান্য জটিলতায় আটকে জান। আর্থিক জটিলতা ক্যান্সার চিকিৎসায় অন্যতম বাধা ও প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
ক্যান্সারের ধরন শনাক্ত করার জন্য করা হয় ইম্যুনো হিস্ট্রোক্যামিস্ট্রি। এই পরীক্ষাটা আপনার ক্যান্সারের প্রকৃত অবস্থা উদ্ভাবন করে এমনকি কোন ধরনের মেডিসিন প্রয়োগের মাধ্যমে আপনার রোগ নিরাময়ে সবচেয়ে বেশি উপযোগী হবে সেটার প্রমাণ দেয়।
এছাড়াও ক্যান্সার চিকিৎসায় স্ট্যান্ডার্ড স্টেইজিং ইনভেস্টিগেশন লাগতে পারে যা সিটি স্ক্যান, এম আর আই, পেট সিটি স্ক্যান ইত্যাদি। এর বাইরে স্ক্রিনিং টেস্ট আছে অনেক সেগুলোও সহজলভ্য নয় সব যায়গায়। অথচ স্ক্রিনিং টেস্ট গুলো অনেকের জীবনে ক্যান্সারের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে পারে। প্রতিকার থেকে প্রতিরোধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্ক্রিনিং টেস্টের পাশাপাশি ডায়াগনস্টিক টেস্টগুলোও সহজলভ্য ও সহজসাধ্য করা জরুরি।
এতোগুলো পরীক্ষা করার মূল উদ্দেশ্য আপনাকে সঠিক চিকিৎসার দিকে ধাবিত করা বা ক্যান্সার আগে আগেই প্রাথমিক অবস্থায় চিহ্নিত করা।
বিশ্বের সব দেশে এই সকল পরীক্ষা করার পরই ক্যান্সারের চিকিৎসা শুরু করা হয়। কাজেই আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা পেতে হলে আপনাকে অবশ্যই একটি প্রসেসের মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং এতেই আপনি যথার্থ চিকিৎসা এবং ফলাফল পাবেন। এখন কথা হচ্ছে এই ধাপগুলো আমাদের দেশের দরিদ্র মধ্যবিত্ত মানুষদের জন্য কতটা সহজলভ্য ও সহজভাবে বোধগম্য করার ব্যবস্থা করা হয়েছে?
এসব জটিল হিসেব সাধারন মানুষ করতে না পেরে চিকিৎসায় অবহেলা করেন এবং দিন দিন পরিস্থিতি যে খারাপের দিকে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল থাকে না। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায় দেশব্যাপী সাধারণ মানুষের জন্য সেসব নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকদের এখনই ভাবতে হবে এবং দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: ডা. রিফাত আল মাজিদ
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ক্যান্সার কেয়ার এন্ড রিসার্চ ট্রাস্ট,বাংলাদেশ
ক্লিনিক্যাল কো–অর্ডিনেটর, র্যামফিট মেডিকেল কনসাল্টেশন সেন্টার, মগবাজার,ঢাকা
এই লেখাটি বাংলাদেশের অন্যতম পঠিত দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত হয় বিশ্ব ক্যান্সার দিবস উপলক্ষে।